ডাঃ ফারহানা মোবিন:: হঠাৎ বেজে উঠল মোবাইল ফোন। আমিনুল সাহেব ভীষণ বিরক্ত হয়ে দেখলেন তার মা মিশ কল দিয়েছেন। বিরক্ত হয়ে বৃদ্ধা মাকে বকা দিলেন সব কলিগদের সামনে। চিৎকার করে বললেন, তুমি ব্রিটিশ আমলের মানুষ, তুমি যখন তখন ফোন করে ফেলো, জানোই না যে, মিটিং এর সময় ফোন করতে হয়না। ছেলের চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে গেলেন বৃদ্ধা মা।
মাঃ বাবা, আমিতো জানিনারে কখন তোর মিটিং থাকে। তাই ভুল করে ফোন করে ফেলেছি।
ছেলের বকা খেয়ে দুচোখ ভিজে উঠল বৃদ্ধা মায়ের। ছানি পড়া চোখটি আরো ঝাপসা হয়ে উঠল।
দরজাতে কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলতেই উপমা প্রশ্ন করলঃ দীদা, তুমি দরজা বন্ধ করে কেন ফোন করো? তোমার এত গোপন কি কথা থাকে?
দীদাঃ নারে দাদু ভাই, তোর বাবার সাথে আমার কোন গোপন করা নাই। কারো সাথে আমার কোন গোপন কথা থাকেনা। তাহলে এইভাবে চুরি করে ফোন করো কেন, প্রশ্ন করল উপমা।
দীদাঃ তোর বাবাকে ফোন করতে দেখলে, তোর মা খুব বিরক্ত হবে।
উপমাঃ আমার বাবা তোমার ছেলে, তুমি তাকে ফোন করতেই পারো।
দীদাঃ ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেলে সবাই বাবা মার আপন থাকে না।
উপমাঃ তাহলে বড় হয়ে কি আমিও বাবা মায়ের পর হয়ে যাবো?
দীদাঃ না দাদু ভাই, তুই খুব ভালো মেয়ে। ভালো মেয়েরা সবার আপন থাকে। তোর বাবা আমাকে যেভাবে কষ্ট দিচ্ছে, তুই কখনো তোর বাবা মাকে কষ্ট দিবিনা।
উপমাঃ তুমি কাঁদছো কেন? কই কাঁদছিনাতো।
দীদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল উপমা। দীদা হাত বুলাতে লাগলেন উপমার মাথায়। মনোযোগ দিয়ে উপমা শুনতে লাগলো পুরানো দিনের গল্প।
হঠাৎ ঘরের বাহিরে প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচি।
উপমা লাফ দিয়ে উঠল বিছানা থেকে। এক চোখ দিয়ে মালতি বেগম দেখলেন তার ছেলের বউ চিৎকার করে বছলেনঃ কেন মা, তোমাকে জমির ঐ ভাগ দিবে? মা আমার বাসায় থাকে, তার একটা খরচ আছেনা, ঐ জমির ভাাগ আমাদের। মা ঐ জমি কাউকে দিতে পারবেনা। আমি কাউকে দিতে দিবোনা। জমির ভাগ আমাকে দিয়ে তারপরে এই বাসা থেকে জাহান্নামে যাক। তাতে আমার কোন আপত্তি নাই।
ছেলের বউ এর কথা শুনে মালতি বেগমের বুকে তীব্র ব্যথা অনুভব হলো। তিনি বসে থাকতে পারলেন না। বিছানায় শুয়ে পড়লেন।
উপমাঃ দীদা আমি সোনারগাঁ হোটেলে চলে যাচ্ছি। সাঁতার কাটতে, এইসব টাকা পয়সার ঝগড়া আমার ভালো লাগছেনা। আর শোনো তোমার মোবাইলে ৫০০ টাকা দিয়েছি। তুমি যার সাথে ইচ্ছা মন খুলে কথা বলো। তুমি ৫০ টাকার জন্য বাবা আর ফুফুদের কাছে হাত পাতো আমার খুব খারাপ লাগে। তুমি আমার কাছে থেকে নিবা।
দীদাঃ তুই টাকা পাবি কোথায়?
উপমাঃ আমি প্রতি মাসে ১০০০ টাকা স্কলারশীপ পাই।
এই ১০০০ থেকে ৫০০ টাকা তোমার, ৫০০ আমার। আবেগ আর আনন্দে মালতি বেগম বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন তাঁর নাতিকে।
দীদাঃ তুই ছাড়া আমার কেউ নাইরে। তুই আমার খুব ভালো বন্ধু।
– ২ –
এক মাস পরের ঘটনা। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল মালতি বেগমের। বাসার মধ্যে উকিল, পুলিশ, কোর্টের লোকজন। কি ভয়ঙ্কর কথা। এতো মানুষজন কেন? বিছানা থেকে নামতে পারছিলেন না তিনি। দৌঁড়ে এসে মহিলা এক পুলিশ তাঁকে বিছানা থেকে টেনে হিচড়ে নামালেন। ৫ মেয়ে আর ৪ ছেলে, নাতি, নাতনি, মেয়ের জামাই; ছেলের বউরা চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করলেন মালতি বেগমের নামে বরাদ্দ থাকা ৫ কাঠা জমির ভাগ নেবার জন্য।
মালতি বেগমঃ বাবা তোরা আমার সাথে এইভাবে গন্ডগোল করিস না, আমার খুব শরীর খারাপ।
মীনা বেগমঃ দেখো মা, এসব নাটক করবানা। ভালো মানুষের মতো জমিটা আমাদের লিখে দাও। তা না হলে তোমার বিরুদ্ধে কেস করবো। আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো।
মালতি বেগমঃ মা, তুই আমার সন্তান হয়ে এই কথা বলতে পারলি!! ওই জমিটা আমি রেখেছি কাব্যর জন্য। কাব্যকে আমি রাস্তা থেকে তুলে এনে মানুষ করেছি। তোরা এতো বড় বড় চাকরি করিস যে, আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি, এইটা জানার সময় তোদের নাই। আজ কতো বছর পরে তোদেরকে একসাথে দেখলাম। আমি এতো দুর্ভাগ্যবান মা যে, ঈদের দিনেও তোদের সবাইকে দেখতে পাইনা। আজ জমির ভাগ নিতে তোরা সবাই উপস্থিত। আমাকে জেলখানায় পাঠানোর জন্য এসেছিস, তবুও ভালো তোদেরকে দীর্ঘ বছর পরে অন্তত একসাথেতো দেখতে পেলাম।
রাকিব খান (২নং ছেলে)ঃ মা তাড়াতাড়ি দলিলে স্বাক্ষর দাও। তোমার সাথে এতো কথা বলার সময় আমাদের নাই। তুমি বেকার মানুষ। তোমার কাজ নাই। কিন্তু আমাদের অনেক কাজ আছে। তাড়াতাড়ি স্বাক্ষর দাও। নইলে সত্যিই আমরা তোমায় আদালতে নিয়ে যাবো। কাব্যকে আমাদের টাকাতে মানুষ করেছো, এটাইতো যথেষ্ট। ওকে জমি দিবা কেন?
মালতি বেগমঃ তোদের সবাইকে আমি বাড়ী, গাড়ী, ব্যাংকের টাকা সব ভাগ করে দিয়েছি। আমার ভাগের ৯০ ভাগ তোদেরকে দিয়েছি। কাব্যকে আমি মাতৃ¯েœহে বড় করেছি। ওর বাবা মার কোন পরিচয় নয় ঠিকই কিন্তু মানুষ হিসাবে সে বড় ভালো। আমি এই জমি ওকেই দিবো। এটা আমার দীর্ঘ বছরের ইচ্ছা।
ঝগড়া, চিৎকার চেঁচামেচি আর ছেলেমেয়েদের লালসার কাছে হার মানলেন মালতি বেগম। ৫ কাঠা জমি দিয়ে দিলেন ৯ ছেলে মেয়েকে। এইবার ৫ কাঠাকে ৯ ভাগ করার জন্য বেধে গেল মহাযুদ্ধ। প্রচন্ড পরিমাণে বুকে ব্যথার জন্য মালতি বেগম ঘরে যেয়ে দরজার বন্ধ করে শুয়ে পড়লেন।
পরদিন সকাল বেলা। আকাশ ভরা মেঘ। সরকারী ছুটির দিন। আমিনুল সাহেবের বাসার বুয়া, মালি, ড্রাইভার, উপমা দরজা ভেঙ্গে বের করল মালতি বেগমকে।
নিথর দেহে পড়ে আছেন মেঝেতে। দুচোখ থেকে গড়িয়ে যাওয়া পানিগুলো মিশে গেছে গালের সাথে। ডান হাতে ধরে ছিলেন একটি চিঠি। তাতে লেখা, “উপমা, দাদুভাই, আমায় ক্ষমা করে দিস। তোকে ছেড়ে চলে গেলাম ওইপারে। দীর্ঘ বছর ধরে সবার এই অপমান আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম নারে। আমাকে আর কষ্ট করে ওল্ড হোমে পাঠাতে হবে না। দাদু ভাই, তোর জন্য আমার একটি কিডনী তোকে দিয়ে গেলাম। এইবার তোর কিডনী ট্রান্সপ্ল্যানটেশানটা হবে। আমি সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। তুই তাড়াতাড়ি সুস্থ্য হয়ে যাবি। বিদায় দাদু ভাই। আমাকে ক্ষমা করে দিস।”
উপমা কাঁদতে পারছেনা। বাক রুদ্ধ হয়ে তাঁকিয়ে আছে দীদার এক পা ভাঙ্গা টেবিলের দিকে। শূণ্য আর নিথর হয়ে পড়ে আছে দীদার কালো চশমা। চশমাটি আজ বেদনায় হয়ে গেছে নীল।
ডাঃ ফারহানা মোবিন
এমবিবিএস (ডি.ইউ), এমপিএইচ (
এমবিবিএস (ডি.ইউ), এমপিএইচ (ইপিডেমিওলজি-থিসিস পার্ট),
পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ট্রেনিং ইন গাইনী এন্ড অবস্ (স্কয়ার হাসপাতাল),
রেসিডেন্ট মেডিকেল অফিসার (গাইনী এন্ড অবস্),
স্কয়ার হাসপাতাল, ঢাকা, বাংলাদেশ।